জাতির সংজ্ঞা দাও। জাতি গঠনের উপাদানসমূহ কী?
অথবা, জাতি বলতে কী বোঝ? জাতির স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকা: যে-কোনো সমাজে জাতি চেতনার উন্মেষ ঘটে দ্বিবিধ উপাদান সহযোগে, যথা- ভাবগত উপাদান ও বাহ্যিক উপাদান। ভাবগত উপাদান বলতে বোঝায় সমষ্টিগত পর্যায়ে অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে জনসাধারণের ঐক্যবোধ এবং অভিন্ন রাজনৈতিক জীবন প্রতিষ্ঠার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। বাহ্যিক উপানান হলো পরিবেশের ঐক্য ও সমতা। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে জাতি গঠনে ভাবগত উপাদানের প্রভাব বেশি।
জাতি: ল্যাটিন শব্দ natio থেকে Nation শব্দটির উদ্ধৃত হয়েছে। জাতি একটি সত্তা যা জাতীয়তাবোধের ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয় এবং জনসমষ্টি যখন একটি ভূখণ্ডে, একই ভাষা, একই ধর্ম, একই ঐতিহ্যে, একই প্রথায়, একই নীতি ও আদর্শ মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে আচার ব্যবহারে লিপ্ত থাকে তখনই তা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
গ্রামাণ্য সংজ্ঞা: জাতি সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষী বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন, যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
লর্ড ব্রাইস বলেন, "A nation is a nationality when is has organized it self into a political body either mdependent or desiring to be indepedent"
ড. এমাজউদ্দীন আহমদ-এর মতে, "জাতি বলতে আমরা এক জনসমষ্টিকে বুঝি যারা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে তাদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছে অথবা কায়েম করতে আগ্রহী।"
ব্রাইট-এর মতে, "জাতি বলতে একটি রাষ্ট্রকে বোঝায় যা হবে স্বাধীন, এর থাকবে একটি কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত রাজনৈতিক একক যাকে একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজনৈতিক সত্তাকে বোঝায়।"
Anderson-এর মতে, "it in an imagined political community and imagined as both inherently limited and sovereign
অধ্যাপক ম্যাকাইভার জাতি সম্পর্কে বলেন, "জাতি হাসা ঐতিহাসিক পরিস্থিতির দ্বারা স্পষ্ট, আধাত্ম্য চেতনার দ্বারা সমর্থিত একত্রে বসবাস করার সংকল্পবদ্ধ সম্প্রদায়গত মনোভাবসম্প জনসমাজ। যারা নিজেদের জন্য সাধারণ সংবিধান রচনা করতে চায়।
জাতি গঠনের উপাদানসমূহ
নিম্নে জাতি গঠনের প্রধান প্রধান উপাদানগুলো উল্লেখ করা হলো-
১. নির্দিষ্ট ভূখণ্ড: কতকগুলো লোক এক নির্দিষ্ট ভূগছে বাস করলে তারা এক জাতিতে পরিণত হয়। নির্দিষ্ট ভূখণ্ড আতি গঠনের পক্ষে উপযোগী। তবে বিভিন্ন ভূখণ্ডে বাস করেও লোকেরা একটি জাতি গঠন করেছে এমনো দৃষ্টান্ত রয়েছে। নির্দিষ্ট ভূখণ্ড জাতি গঠনের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তবে অপরিহার্য নয়।
২. কুলগত ঐক্য: জাতি গঠনে কুলগত ঐক্যের প্রভাব সুদুরপ্রসারী। রক্তের সম্বন্ধ মানুষকে কাছে টানে, দূরকে নিকট করে এবং একপ্রকার মানসিক ঐক্য সৃষ্টি করে, যার আকর্ষণ দুর্নিবার। জাতি গঠনের জন্য বংশগত ঐক্য বা ফুলগত ঐক্য একটি প্রধান উপাদন। সমস্ত মানুষ যখন একই বংশোদ্ভূত বলে মনে করে, তখনই তদের মধ্যে একান্ততা, ভাব গড়ে ওঠে এবং পরস্পরকে ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করে। কিন্তু আধুনিক নৃতত্ত্ববিদগণের গবেষণার ফলে কুলগত ঐক্য কাল্পনিক সম্বন্ধ বলে প্রমাণিত হয়েছে। পৃথিবীর কোনো জাতির মধ্যেই রক্তের বিশুদ্ধতা নেই।
৩. ভাষাগত একতা: ভাষাগত একতা ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রধান সেতুবন্ধন। ভাষাগত ঐক্য জাতি গঠনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। সুইজারল্যান্ডে তিনটি ভিন্ন ভাষাভাষী লোক বাস করে কিন্তু তাদের ভাষাগত বিভেদ জাতি গঠনের অন্তরায় হয় নি।
৪. ধর্মের একতা: ধর্মের ঐক্য জাতি গঠনের এক অন্যতম সূত্র। এর ভিত্তিতে এশিয়া ও ইউরোপে অনেক জাতি-রাষ্ট্রের জিব হয়েছে। তবে ধর্মের ঐক্য যে একান্ত প্রয়োজনীয় তা সঠিক নয়। বিভিন্ন ধর্মের লোকদের মধ্যেও জাতি গঠনের প্রয়াস লক্ষণীয়। ধর্মের একতার ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্ম হয়।
৫. অর্থনৈতিক ঐক্য: অর্থনৈতিক অবস্থার সমতা ও জনসাধারণকে জাতি গঠনের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে। সকলের অর্থনৈতিক স্বার্থ হলো তারা নিজেদেরকে এক ভাবতে শেখে।
৬. ঐতিহ্যগত ঐক্য: জনগণের মধ্যে এক ঐতিহ্যবোধ থাকলে অতীতের গৌরব যা যৌথ কর্মের প্রেরণা তাদের মহামিলনের সূত্রে আবদ্ধ করে।
৭. ভাবগত ঐক্য: জাতি গঠনের মূল উপাদান সংহতি বোধ এবং মিলনের অসীম আনন্দ। জাতি গঠনের ব্যাহিক উপাদানগুলো সব সময়ে বিশেষ কার্যকরী হয় না। এগুলোর অবর্তমানেও জাতির সৃষ্টি সম্ভব। জাতীয় জনসমাজ বা জাতি গঠন প্রধানত নির্ভর করে জাতির এক বিশেষ মনোভাবের ওপর, যখন জাতীয় জনসমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিই তাদের মূল্যবোধগত ঐক্যে একান্ত আস্থাবান হয়ে এক জাতিত্ববোধে অনুপ্রাণিত হয়, তখনই কুলগত, ভাষাগত বা ধর্মগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা এক জাতিতে পরিণত হয়। ভাবগত ঐক্য একটা মানসিক অনুভূতির ব্যাপার।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, জাতি বলেতে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী এক জনসমষ্টিকে বোঝায়, যারা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ। জাতি স্বাধীনতাকামী হতে পারে অথবা স্বাধীন হতে পারে। বর্তমানে জাতি হলো এমন একটি জনসমতি, যা রাজনৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসচেতন ও সংগঠিত।

No comments:
Post a Comment